‘স্বগগো থেকে এলো রথ
নামলো খেতুতলে
চব্বিশ কুটী বাণবৰ্ষা শিবের সঙ্গে চলে–
সত্যযুগের মড়া আর শাওল যুগের মাটি
শিব শিব বল রে ভাই ঢাকে দ্যাও কাঠি—’
নিশ্চিন্দিপুরে সেবার চড়কে হাজির নীলমণি হাজরার দল। বারোয়ারি চড়কপুজোর আগের দিন গ্রামে নীলপুজো। খেজুর গাছের কাটা ভাঙার রেওয়াজ ওদিন। অপু ও দুর্গা কাটা ভাঙা দেখতে জড়়ো হল চড়কতলার মাঠে। মুখুয্যেদের বাড়ির মেয়ে টুনু, রাণীদের সঙ্গে সেখানে হঠাৎ দেখা। রাতে সন্ন্যাসীরা চালান দেবে, সেই নিয়ে শুরু হল গল্প। শশ্মান চালান বা হাজরা চালানের পুজো বেশ ভয়ানক। মড়া নিয়ে চলে নানাবিধ মন্ত্র পাঠ। তেমনই এক ‘মন্তর’ এই লেখা শুরুর ছড়াটি। রাণুদিকে শোনানো এই ছড়া আজ দুর্গার মুখে অমর হয়ে রয়েছে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে।
‘আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই’
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তেরোটি পার্বণের সবকটি নাম স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও চৈত্র মাসের চড়ক পুজো এই তালিকার শেষ পার্বণ বলে ধরা হয়। একটা সময় চৈত্রের শুরু থেকে এক মাস ধরে এই পার্বণ উদযাপনের রীতি ছিল। বর্তমানে চড়ক এক সপ্তাহ বা ২-৩ দিনের উৎসবে এসে ঠেকেছে। মূলত সমাজের ‘নিম্নবর্গীয়’দের উৎসব। তারাই এদিন বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর সাজপোশাকে শিবের অনুচর ভূতপ্রেতের রূপ ধারণ করে। দেবতার কাছে নিবেদন করে নিজেদের। সন্ন্যাস পালন, ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার চড়ক পুজোর রীতি। কেন এই ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার? চড়কের দেবতা শিবের কাহিনিতেই নিহিত সেই সূত্র। শিবের গাজন চড়ক পুজোর প্রাণ। সেই শিব, যিনি হলাহল পান করেছিলেন জগতের হিতার্থে, বিভূতিই (ছাই) যাঁর ভূষণ, বস্ত্র বলতে বাঘছাল, আর সার্বিক উপস্থাপনা জাগতিক কামনাহীন। তবে আরাধ্য দেবতা শিব হলেও গাজনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই পার্বণের মূল উৎস বৌদ্ধধর্মে।

ভিক্ষা করা খাবার
নামে বসন্ত হলেও আদতে বসন্ত নয়। এমনই গরম বসন্ত ঋতুর দ্বিতীয় মাস চৈত্রে। আর এই গরমেই গোটা বাংলা জুড়ে চড়ক পার্বণের নানা দৃশ্য। উত্তরে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত বাংলার বিভিন্ন গ্রামে এই উৎসব আজও বেশ জনপ্রিয়। মাসের শেষ দিকে গোটা গ্রাম জুড়ে সন্ন্যাস নেওয়া পার্বণের মূূল রীতি। একজন সাজেন প্রধান সন্ন্যাসী। বাকিরা তাদের অনুগামী হন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে চলে অন্নভিক্ষা। বহুরূপী সাজার রীতিও এই চড়কের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দু’জন সাজেন শিব-দুর্গা, বাকিরা লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী। ভিক্ষা করা খাবার সন্ধেয় পাক করে খান সকলে।
আগের দিন নীলপুজো
একে একে সব সন্তানদের হারিয়ে কাশীবাসী হয়েছিলন এক ধার্মিক ব্রাহ্মণ দম্পতি। কাশীতেই একদিন গঙ্গা স্নানের সময় ব্রাহ্মণীর কাছে এসে দাঁড়ান এক বৃদ্ধা। দুঃখের বৃত্তান্ত শুনে বৃদ্ধা নিদান দেন চৈত্র সংক্রান্তির প্রথম দিন উপোস করে সন্ধেবেলা শিবপুজোর। সেই মতো পুজোর পরেই নীলকণ্ঠের তাঁর আশীর্বাদেই ব্রাহ্মণী গর্ভবতী হন। লোককথা মতে, ওই বৃদ্ধা আর কেউ নন, স্বয়ং মা ষষ্ঠী। যিনি গর্ভবতী মা ও সন্তানদের রক্ষা করেন। এর পর থেকেই চৈত্রের এই সময় নীল পুজো নামে খ্যাত হয় নীলকণ্ঠের আরাধনা। সন্তানের মঙ্গলকামনায় নীলষষ্ঠীর ব্রত পালন আদতে সেই কাহিনিরই অনুসারী বলে মত অনেকের।

শশ্মান চালানের পুজো
নীলপুজোর রাতে অর্ধনারীশ্বরের পুজো বাংলার বহু স্থানে চড়ক সংস্কৃতির অঙ্গ। সাধারণত শিবের মাথায় দুধ ঢালার পর উপোস ভাঙার রীতি। তবে ষাঁড়ের পিঠে বসে থাকা এই ঈশ্বরের আরাধনার পরেও অনেকে উপোস ভাঙেন। এর পর মড়ার মুণ্ডু বা দেহ নিয়ে শশ্মান চালান বা হাজরা চালানের পুজো শুরু হয়। ওই রাতে শিবের অনুচর ভূত-প্রেত-দৈত্যের সাজে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন শিবভক্তরা। এর পর মন্ত্রপাঠের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় চালান দেওয়া। অশুভ শক্তির থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রধান সন্ন্যাসী প্রথমে ‘ধূপড়া বা লোহা সূরা’ মন্ত্র পড়ে সকলের দেহবন্ধন করেন। হাতে থাকে ত্রিশূল ও অন্যান্য অস্ত্র। গোটা রাত চলে এই বিশেষ পুজো। রাতের শেষ প্রহরে প্রধান সন্ন্যাসী জলে নেমে ভাত, শোল বা বোয়াল মাছ পোড়া শালপাতা বা মালসায় বেড়ে ভূতপ্রেতের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। সেই সময় তাঁকে ধরে থাকেন অন্যরা। যাতে ভূত তাঁকেও না নিয়ে চলে যায়।
চড়ক গাছে পাক
নীলপুজোর পর দিনই অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পুজো। পিঠে বড়শি গেঁথে চড়ক গাছে নিজেকে বেঁধে পাক দেওয়া এই পুজোর পরিচিত আরেক রীতি। কলকাতার ছাতুবাবুর বাজারেও এই রীতি দেখা যায়। সারা বছর জলে ডোবানো থাকে একটি গাছের কাণ্ড। চড়কের আগের দিন সেটি জল থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে তোলা হয়। এর পর ওর ডগায় শিবের মূর্তি স্থাপন করে বাঁশের ঠেকা দিয়ে মাটিতে পোঁতা হয়। এই গাছেই শিবভক্তরা ফুল ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘোরেন। পিঠে বড়শি গাঁথার কাজ করেন পুরোহিত। এমনভাবে গাঁথা হয় যাতে রক্ত না বেরোয়। রক্ত বেরোলেও গরম ঘি দিয়ে তা বন্ধ করা হয়। উপর থেকে ছোঁড়া ফুল ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে কুড়িয়ে নেয়। মনে করা হয়, এই প্রসাদ খেলেই পুণ্য লাভ নিশ্চিত।

ধর্মঠাকুরের পুজো
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন পুরাণ ও বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, কিছু উৎসব বা পার্বণের উল্লেখ দুটো ধর্মেই রয়েছে। এক সময় ভারতীয়দের আধ্যাত্মিক জীবনে বৌদ্ধধর্মের গুরুতর প্রভাবই এর কারণ। চড়কের ইতিহাসেও পাওয়া যায় এই অদ্ভুত সমাপতন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, শিবলোক প্রাপ্তির জন্য ভক্তদের মধ্যে চৈত্র মাসে নৃত্য উৎসব পালনের রীতি ছিল। আবার গ্রামীণ লোককথা অনুযায়ী, দ্বারকার অধিপতি তথা বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হন পরম শিবভক্ত বাণরাজা। কিন্তু অমরত্ব পাওয়ার আকাঙ্খায় তিনি চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুচরদের নিয়ে নাচেগানে আত্মহারা হয়ে শরীরের সব রক্ত বের করে শিবের চরণে সমর্পণ করেন। সেখান থেকেই শুরু চড়ক পুজো আর শিবের গাজনের। অন্য দিকে হিন্দু ধর্মের পণ্ডিতদের কথায়, পাশুপাত (পশুপতি শিবের অনুগামী যারা) সম্প্রদায় বহু প্রাচীন কাল থেকেই এই পুজো করত। তবে বাংলার নিজস্ব সম্পদ ধর্মমঙ্গল কাব্য মতে, রানি রঞ্জাবতী ধর্মঠাকুরকে সন্তুষ্ট করতে গাজনের আয়োজন করেছিলেন। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব। কারণ বাংলার নানা অংশে বুদ্ধদেব ধর্ম নিরঞ্জন নামেও পূজিত হতেন।
বজ্রযানী তান্ত্রিক রীতিনীতি
সপ্তম শতাব্দীর শেষ। বাংলাসহ গোটা দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব নিবু নিবু। এই সময় বাংলার বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা অনেকেই হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। যেটুকু সম্পদ বুদ্ধের ধর্ম থেকে তাঁরা বয়ে আনেন, তা ছিল বজ্রযানী তান্ত্রিক রীতিনীতি। ভয়াবহ কিছু তান্ত্রিক আচার ছিল বজ্রযানীদের সাধনার পথ। পরে এই রীতিনীতির ছিটে পড়ে চড়কের মাঠে।
ডোমপণ্ডিতদের পুজো
বাংলার পার্বণ ও সংস্কৃতির ইতিহাস যাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁদের মতে, শিবের গাজনের নাম তখন ছিল ধর্মের গাজন। রাঢ়বঙ্গের মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ২৪ পরগনায় ধর্মের পুজো এখনও প্রচলিত চড়কের দিন। কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার ইতিহাস ঘাঁটলেও এই তত্ত্বের সমর্থন পাওয়া যায়। নদীর ধারেই বাস ছিল জেলে ও ডোমদের। ডোমপণ্ডিতরা ছিলেন ধর্মরাজের পুজোয় মূল পুরোহিত। ধর্মরাজের পুজো থেকেই ধর্মতলার নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়।

বুদ্ধদেবের ধর্ম রূপ
ধর্মরাজের কোনও মূর্তি নেই। একটি শিলাখণ্ডকে পুজো করার রীতি। বৌদ্ধধর্মে বুদ্ধদেবকে ধর্ম নিরঞ্জন রূপে আরধনার রীতি ছিল। বৌদ্ধধর্ম থেকে এই রীতি এসেছে বলে বাঁকুড়ার নানা অঞ্চলে এখনও ধর্মের মূর্তি হিসেবে চড়কের দিন বুদ্ধের মূর্তিকেই পুজো করতে দেখা যায়। ইতিহাসের এক নির্মম নিয়ম এই যে, রাজধর্ম কখনও কখনও একটি বিস্তৃত অঞ্চলের ধর্ম হয়ে ওঠে। ফলে প্রজাদের মধ্যেও ব্যাপক ধর্মান্তরণ দেখা যায়। কিন্তু পূর্বধর্মের কিছু রীতিনীতি অবশেষ হিসেবে তাঁদের মনের ভিতর থেকে যায়। ঠিক যেমন থেকে গিয়েছিল ধর্মরাজের আরাধনা। বল্লাল সেনের সময় যখন বৌদ্ধরা নিপীড়িত হলেন, তখন পাল্টে গেল বাংলার বহু সংস্কার। বৌদ্ধধর্মের ধর্মরাজের আরাধনাও নাম পাল্টে ধর্মের গাজন হয়ে গেল। মিশে গেল বাংলার পার্বণের ভিড়ে। এভাবেই কখন যেন ধর্মের গাজন হয়ে উঠল শিবের গাজন। বাংলার জেলে, ডোম ইত্যাদি নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল বজ্রযানী বৌদ্ধ সংস্কৃতি। আবার তারাই ছিল শিবের একনিষ্ঠ উপাসক। ঐতিহাসিকদের মতে, এখানেই মিলেমিশে গিয়েছে দুটি ভিন্ন পথ। উৎপত্তি অন্য়ত্র হলেও গাজন হয়ে উঠেছে গ্রাম বাংলার ভূমিসংস্কৃতি।