আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলল বাংলাদেশ। রয়টার্সের পেশ করা নথি অনুসারে, ভারতীয় এই সংস্থার বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে কর সংক্রান্ত সুবিধাগুলি (ট্যাক্স বেনিফিটস) আটকে রাখার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারতের আদানি গোষ্ঠী। সেই চুক্তি অনুসারে, পূর্ব ভারতে আদানির যে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, সেখান থেকে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে ওই সংস্থা।
সেই সময় কোনও রকম টেন্ডার ছাড়াই দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর (নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা) প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এই চুক্তি কার্যকর করা হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অভিযোগ, টেন্ডার ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট সংস্থার কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার এই চুক্তি ঢাকার পক্ষে বড্ড বেশি দামি হয়ে গিয়েছে!
দাবি করা হচ্ছে, অন্য়ান্য কয়লা বা বিদ্যুৎ চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে যত টাকা খরচ করতে হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি টাকা আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে দিতে হয়েছে। এর স্বপক্ষে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে প্রয়োজনীয় নথিপত্র রয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে।
রয়টার্স সূত্রে খবর, সেই নথি তারা দেখেছে। এমনকী, এই বিষয়টি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের মধ্যে যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল, সেই সংক্রান্ত তথ্যও রয়টার্সের কাছে রয়েছে। যদিও এত কিছুর পরও ঢাকার তরফে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তারা আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পাদিত এই বিদ্যুৎ চুক্তি পুনরায় বিবেচনা করে দেখতে চায়।
এদিকে, চুক্তি অনুসারে ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে দেয় আদানি গোষ্ঠী। অভিযোগ, সেই বিদ্যুতের বিল মেটাতে পারেনি ঢাকা। যার পরিমাণ কয়েকশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার! এদিকে, তার মধ্য়েই বকেয়া বিলের আর্থিক পরিমাণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সাক্ষাৎকারে কার্যনির্বাহী বিদ্যুৎ মন্ত্রী মহম্মদ ফউজুল কবীর খান জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে পরিমাণ বিদ্যুতের উৎস রয়েছে, তাতে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কিনেও সারা দেশের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু, সমস্যা হল - দেশীয় উৎসগুলির সবক'টা এই মুহূর্তে সচল নেই।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে প্রথমবার একটি বিষয় সামনে এসেছে। তা হল - সংশ্লিষ্ট চুক্তিটির সঙ্গেই আরও একটি অতিরিক্ত চুক্তি কার্যকর করার কথা বলা হয়েছিল। যেখানে কর সংক্রান্ত বিভিন্ন সুবিধা স্থানান্তর করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল।
এর আগেই রয়টার্সের তরফে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ২৫ বছরের ওই চুক্তি পুনরায় শুরু করতে আগ্রহী। এই অবস্থায় গত নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘুষ সংক্রান্ত মামলায় আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানি-সহ সংস্থার বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্তার বিরুদ্ধে সেখানকার আদালত পদক্ষেপ করে।
রয়টার্স সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, আদানির বিরুদ্ধে ওঠা এই ঘুষের অভিযোগটিকেই নাকি হাতিয়ার করতে চাইছে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। তারা এই পরিস্থিতিতে আদানি গোষ্ঠীর উপর চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পুনরায় বিবেচনা করতে এবং তা নতুনভাবে কার্যকর করতে চাইছে।
কিন্তু, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ওঠেনি বলে পালটা দাবি করছে ভারতের এই সংস্থা। আদানির এক প্রতিনিধি রয়টার্সকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির সমস্ত শর্ত তাঁরা মেনে চলেছেন।
ওই প্রতিনিধির আরও দাবি, বাংলাদেশের সরকার সংশ্লিষ্ট চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছে, এমন কোনও তথ্য তাঁদের অন্তত জানা নেই। তবে, বাংলাদেশ তাঁদের সংস্থার বিরুদ্ধে কর সংক্রান্ত সুবিধাগুলি আটকে রাখা-সহ যেসব অভিযোগ তুলেছে, তা নিয়ে অদানির ওই প্রতিনিধি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
কর সংক্রান্ত সুবিধা নিয়ে বিতর্কটা ঠিক কী?
মূলত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্যই আদানি গোষ্ঠী গোড্ডা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি গড়ে তুলেছিল। এই কেন্দ্র চালানোর জন্য বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করা হয়।
সংস্থার দাবি ছিল, এই চুক্তির ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। তার ভিত্তিতে ২০১৯ সালে ভারত সরকার সংশ্লিষ্ট এলাকাটি, অর্থাৎ যেখানে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, সেই এলাকাকে স্পেশাল ইকোনমিক জোন ঘোষণা করে। ফলে, তারা ভারত সরকারের কাছ থেকে কর ছাড়ের বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে।
এবার বিষয় হল - আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের যে মূল চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, তার সঙ্গে আরও একটি যে অতিরিক্ত চুক্তি ছিল, সেটি স্বাক্ষর করা হয় ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর। সেই চুক্তি হয় আদানি গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের মধ্যে।
সেই চুক্তি অনুসারে, ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া কর ছাড়ের বিষয়টি বাংলাদেশকে জানানোর কথা ছিল আদানি গোষ্ঠীর। এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশেরও বেশ কিছু আর্থিক সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, আদানি গোষ্ঠী এই কর ছাড়ের কথা বাংলাদেশকে জানায়নি বলে অভিযোগ।
এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল বলে দাবি করা হচ্ছে, তাতেই এই বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছিল বলে রয়টার্স সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। তবে, সেই চিঠিগুলি এখনও পর্যন্ত কোনও তরফেই প্রকাশ করা হয়নি।